ভাষাবিতর্ক নিয়ে তামিলনাড়ু বাদে আর যে দুটো রাজ্য হেডলাইনে আছে, তারা হল মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু কারণগুলো বিভিন্ন। তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি চাপানোর প্রতিবাদের সাথে সাথে ব্যবসায়ীদেরকে মরাঠি বলতে বাধ্য করা, এই লম্ফঝম্ফ নতুন কিছু না, চক্রাকারে পরিবর্তিত হয়। নতুন যেটা হল, সেটা হচ্ছে বাংলা ভাষা শুনে বাংলাদেশী ছাপ দিয়ে ঠ্যাঙানো এবং সীমানার বাইরে বার করে দেওয়া। মহারাষ্ট্রে উত্তর ভারতীয় ঠ্যাঙানো, নতুন কিছু না। বাঙালি ঠেঙানো টাই নতুন। প্রায় সিকি - শতাব্দ মহারাষ্ট্রে কাটানো এক বঙ্গভাষী হিসেবে বোঝার চেষ্টা করছি এই নতুন উৎপাত কে। "সত্য যুগের" কথা: এটা আমার প্রজন্মের বঙ্গসন্তানদের বেড়ে ওঠার যুগের কথা, ষাটের দশক থেকে আশির দশক - আমি দেখিনি। সবই শোনা কথা। তখন দাদর এবং বৃহৎ বোম্বাই এ অনেক গুলি বাংলা স্কুল ছিল, সেখানে বাংলা ভাষা একটা অন্যতম বিষয় হিসেবে পড়ানো হতো, বাঙালি সংস্কৃতির অনুষ্ঠান গুলি, যেমন রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হতো। নাগপুরের দীননাথ স্কুল বাংলা ভাষার সিলেবাস, পরীক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থাপনায় অগ্রণী ছিল। আর মরাঠি ভাষা শিক্ষা? সেই যুগের অনেক বাবা মা খুব গর্ব করে বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা (অর্থাৎ বঙ্গ সন্তানেরা) সব সময় মরাঠিতে “ওদের” চেয়ে বেশি নম্বর পেতো! ধ্রুব সত্য না হলেও অবশ্যই অনেক ক্ষেত্রে সত্য। এই সব বাবা মার প্রজন্ম ও কিন্তু খুব সহজাত ভাবে মারাঠি শিখেছে দেখতে পাই। আরেকটা কারণ হয়ত, সেযুগের এলিট বাঙালি পুণে অঞ্চলে কাজ করত কারখানায়, অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে। "সাধারণ" মানুষের সাথে মিশতে বাধ্য হত। আর আমার ধারণা, এসব বাঙালি বাড়িতে কিন্তু মরাঠি সংস্কৃতি, পুজো আচ্চা সে ভাবে হত না। "মধ্যযুগের" কথা: আমি মহারাষ্ট্রে পা রেখেছি ২০০১ সালে। প্রথম বছর টা কেটেছে মুম্বাইতে। মরাঠি শব্দাবলী কানে বা চোখে আদৌ লাগেনি এই এক বছরে। পরের বছর থেকে পুণেতে। তখন পুণের অটোওয়ালারা মারাঠি বলতে না পারলে নানাভাবে উৎপীড়ন করত। কর্পোরেশন, ইলেকট্রিক সাপ্লাই ইত্যাদি অফিসে যারা মারাঠি বলতে পারেনা, তাদের নানা রকম অসহযোগিতার মুখোমুখি হতে হত। কিছু কিছু মরাঠি অবশ্যই বেশ প্রাদেশিক বোঝা যেত। যদিও এক হাতে তালি বাজে না কথাটা বলতে বাধ্য হব। বাঙালিরা পদে পদে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্যদের সমালোচনা যে ভাবে করত, তাতে বাঙালি বিদ্বেষ না তৈরি হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আমরা তখন যারা শিশুদের অভিভাবক, হাতের কাছে যা ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুল পেয়েছি, বাচ্চাদের সেখানেই ভর্তি করেছি। বোর্ড নিয়ে মাথা ঘামাই নি। বাড়ির কাছে আন্তর্জাতিক স্কুল ( ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নয়, নানা দেশে শাখা সমৃদ্ধ), মধ্যবিত্ত পরিবেশ, মারাঠি বোর্ড। মেয়ে স্কুল জীবন সেখানে আনন্দেই কাটিয়েছে। কিন্তু ওই ১০ বছরে ভালো করে মরাঠি শেখেনি। মেয়ের কাছেই কারণ খানিকটা শুনতে পেয়েছি - ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল বলে এখানে নাকি মরাঠি বলা নিষিদ্ধ ছিল খেলার সময়। কিন্তু বাংলা বলা নিষিদ্ধ ছিল না!!! পরে খেয়াল করেছি, ছোটদের যেমন নানা রকম ছড়া শেখানো হয়, অন্যান্য স্কুলে ভালোই মারাঠি ছড়া শেখানো হতো। প্রতিবেশী শিশুরা বলতো। আমার মেয়ে ওদের চেয়ে একটু বড়। তাই পরে খেয়াল করেছি আমার মেয়ে ওই বয়সে মরাঠি ছড়া শেখেনি। মরাঠি যে ভালো করে শিখছে না সেটা বহুদিন খেয়াল ও হয়নি। তারপরে অষ্টম শ্রেণী নবম শ্রেণীতে দেখলাম ওর বাংলা ভাষার দখল মরাঠি থেকে বেশি ভালো। ভেবেছিলাম তাহলে দ্বিতীয় ভাষা বাংলা হিসেবেই ওকে মাধ্যমিক দেওয়াবো। কিন্তু পরে দেখলাম ব্যাপারটা ঠিক প্রাকটিক্যাল নাও হতে পারে। একটা মাত্র খাতা যদি কোথাও হারিয়ে যায়, পুরো মাধ্যমিক পস্তে যাবে। অগত্যা নানা টিউটর এর সহায়তায় মাধ্যমিক পার হল। ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি যেটা দেখলাম, সেটা হল ডাইজেস্ট দিয়ে প্রশ্ন-উত্তর মুখস্ত করানো। জুনিয়র কলেজে গিয়ে এক ঝাঁক মরাঠি সহপাঠীর মধ্যে মেলামেশা করতেই এক মাসে মরাঠিতে সড়গড় হয়ে গেল , যা দশ বছরে হয় নি।
আমরা এখানে আপনাদের কথা বলার জন্য প্রচেষ্টা করি। তার মধ্যে কিছু আপনাদের ভালো লাগে, কিছু হয়তো নাও লাগতে পারে। আমরা দুটোকেই সমানভাবে সন্মান করি। তাই আপনাদেরই কিছু মন্তব্য আমাদের উদ্দেশ্য , আমরা এখানে প্রত্যয়িত করলাম।.