4thPillar


পহেলগাম থেকে মুর্শিদাবাদ – এক বিদ্বেষের রাজনীতি

ডঃ সুস্মিতা ঘোষApril 26, 2025
পহেলগাম থেকে মুর্শিদাবাদ – এক বিদ্বেষের রাজনীতি

‘সংস্কারী সনাতনীদের মহিলাদের ওপর অত্যাচার করাটা প্রশংসনীয় কীর্তি’ 

1946 সালে আমার মা ছিলেন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কলেজ ছাড়া বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক অল্পই। তাও যাতায়াত পর্দা ঢাকা ঘোড়ার গাড়িতে। আগের বছর মেজমামা বিয়ে করেছেন এক বাঙালি ক্রিশ্চিয়ান মহিলাকে। চিঠি মারফত শুধু ওই খবরটুকুই দিয়েছেন বাবা মাকে এবং এ তরফ থেকে "বউ নিয়ে তুমি বাড়ি এসো" জাতীয় কোন চিঠি যায়নি। কাজেই 1946 এর আগস্ট মাসে নৌসেনা মেজো মামার যখন হঠাৎ যুদ্ধে ডাক পড়ল, তখন 15 দিনের মেয়েকে নিয়ে মেজ মামিমার বাপের বাড়ি যাওয়া স্থির করাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হাওড়া স্টেশন থেকে তখন কিছুতেই খিদিরপুর যাওয়া সম্ভব হল না। সমস্ত ট্যাক্সি বলল লক্ষ টাকা দিলেও ওদিকে যাবে না এবং দাঙ্গাকারীরা শুধু ওদের নয়, দুধের শিশু, তার মা কাউকেই ছাড়বে না। মেজমামা তখন "আমার মা কিছুতেই ফেরাবেন না" দৃঢ় বিশ্বাসে শ্যামপুকুরে দাদুর বাড়িতে এসে মেয়ে বউকে রেখে গেলেন।

নতুন বউ, নতুন নাতনি সবকিছুর আনন্দ খুবই ক্ষণস্থায়ী হল, কারণ পরদিনই সকালে বাড়ির সামনে দেখা গেল পাড়ার ছেলেরা, যাদেরকে বড়জোর মস্তান বলা যায়, এতদিন পর্যন্ত গুন্ডা বলা যেত না, তারা একটা মুসলমান মজুরকে পিটিয়ে মারছে। বেচারি লুকিয়ে ছিল তিন দিন, পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে খাবার খুঁজতে বেরিয়েছিল। এই বীভৎসতা সহ্য করতে না পেরে দাদু বললেন অন্তত আমার বাড়ির সামনে থেকে সরে যা তোরা।

এ গল্প আমি ছোটবেলা থেকে মায়ের মুখে বেশ কয়েকবার শুনেছি। প্রায় একই ধরণের বর্ণনা পরে পড়লাম তপন রায়চৌধুরীর বাঙালনামাতে। কিছু কট্টরপন্থীকে ওনার সম্বন্ধে নানা বিশ্রী অপবাদ দিতে শুনেছি এবং বলতে শুনেছি উত্তর কলকাতার এইসব দাঙ্গার গল্প নাকি মিথ্যে! আমার আধা পর্দানশীন মা এবং তপন রায় চৌধুরী দুজনের মধ্যে একটাই মিল, বয়স। কাজেই সে যাই বলুক, উত্তর কলকাতার সেই দাঙ্গা, যেখানে সাধারণ পাড়ার ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে একটা গরীব মজুরকে মেরে ফেলে, আমি অন্তত তাকে মিথ্যে কিছুতেই ভাবতে পারিনা। কাজেই সামান্যতম সাম্প্রদায়িক মন্তব্যও আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তিকর।

পুণেতে আমার বাসস্থানের দেয়ালের ওপারটাতে যে কমপ্লেক্স, সেখানে অর্থনৈতিকভাবে রুগ্ন জনসাধারণকে থাকার জন্য পুণে মিউনিসিপ্যালিটির নিয়ম অনুযায়ী বাসস্থান বানিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সেই কমপ্লেক্সের অন্য দেয়ালের ওপারে অবস্থিত অতি অভিজাত হাউসিংটি। এই কমপ্লেক্স থেকে যারা হেঁটে বা অটোতে চড়ে বেরোয়, তাদের মধ্যে প্রথমেই নজরে পড়ে বেশ কয়েকজন বোরখাধারী মহিলা। সঙ্গে কয়েকজন শিশু। মেয়ে শিশু হলে কোলেরই হোক বা হেঁটেই চলুক, পরনে হিজাব। এটা আমার ভীষণ অস্বস্তির কারণ, কারণ আমি আমার কম বয়সে এরকম দৃশ্য কখনও দেখিনি। যত ঘনঘন এই মুখহীন প্রাণীদের বেরোতে দেখি, দেখলে যে কোনও লোকের প্রথম ধারণা হবে, ওখানে হয়তো একটা ধর্মাবলম্বী লোকজনই থাকে এবং তাদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু পাঁচিলের এপার থেকে বুঝতে পারা যায়, ওদিকে ধুমধাম করে গণপতি উৎসব, দেওয়ালি ইফতার সবই চলছে। জনসংখ্যার ব্যাপারটাও পরিমিত, সেটাও দেখতে পাওয়া যায়। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বলতে কাদের বোঝায় ঠিক জানিনা, কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের বেশিরভাগেরই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করার জন্য ভ্যান আছে। কিছু না হোক হাত গাড়ি, তাতে বিক্রির মাল বেশ দামি ফল বা সবজি। মুর্শিদাবাদ থেকে আসা দু একজন মুরগির দোকানের কর্মচারীরাও এখানে থাকে, তারা অবশ্যই দরিদ্র। মনে হয় কারও বাড়ি ভাড়ায় থাকে।

এই কমপ্লেক্স এ যাদের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়, ঘটনা চক্রে সবাই মুসলিম। কেউ ফল বিক্রেতা বা বিক্রেত্রী, কেউ দর্জি, কেউ ঘড়ি সারায়। খদ্দের হিসেবে সবাই মোটামুটি খাতির করে। বাঙালি ছেলেগুলোর অবশ্য সব সময়েই গজগজ, যেমন বাঙালিরা করে থাকে। বাকিরা পাক্কা ব্যবসায়ী।


পহেলগাম থেকে মুর্শিদাবাদ – এক বিদ্বেষের রাজনীতি

যখনই সাম্প্রদায়িকতা চাড়া দিয়ে ওঠে, তখন প্রথমেই ওদের মুখগুলো ভেসে ওঠে। না, এত মহান হই নি আমি যে ওদের কি কি ক্ষতি হতে পারে খুঁটিয়ে ভাবতে বসি। আমার বারবার মনে পড়ে মায়ের কাছে শোনা 1946 এর দাঙ্গার কথা। পাড়ার ছেলেদের চোখে কখন পাড়ারই বিধর্মী নিরীহ একজন দুশমন হয়ে ওঠে।  

মায়ের কাছে সেযুগের বর্ণনা যা শুনেছি, “পাড়ার ছেলে” দের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত কমই ছিল। মায়ের নিজস্ব গণ্ডীর মধ্যে প্রায় সবাই  উচ্চশিক্ষিত। প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতাপ চন্দ্র ছিলেন সম্পর্কে দাদা, বাড়িতে তাঁর আনাগোনা ছিল। সহপাঠিনী ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রয়াত অজিত পাঁজার নিজের দিদি স্মৃতি এবং অজিত নিজেও একবছর মায়েদের জুনিয়র ছিলেন ইস্কুলে। বিধান রায়ের আনাগোনা ছিল কলেজে। 

ছোট্ট এই গণ্ডীটুকুর মধ্যে সপ্তদশী মা যেটুকু রাজনীতি বুঝতেন, তার হল শহুরে শিক্ষিত মানুষ মুখে অন্ততঃ দেশপ্রেমের কথাই বলে, স্বদেশী করা মানে আন্দোলন করে জেলে যাওয়া বা ইংরেজের বিরুদ্ধে টুকটাক সশস্ত্র বিপ্লব করা, কেউ কেউ দেশভাগের কথা বলে এবং কোনও  কোনও নেতা আড়ালে দেশভাগের চক্রান্ত করে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।  শিক্ষিত ঘরের যে সব ছেলে মেয়েরা আন্দোলন ইত্যাদি করত, বাড়ির সমর্থন সাধারণত থাকত না, ধরা টরা পড়লে পরিচিতি খাটিয়ে ছাড়িয়ে আনা হত। দাঙ্গার কথা শিক্ষিতরা কেউ ভাবতে পারত না। দাঙ্গা অর্থাৎ মারামারি কাটাকাটি, ছোটলোকে করে। কাজেই উত্তর কলকাতার দাঙ্গা অন্ততঃ উত্তর কলকাতার আদি বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণ্যই লেগেছিল। 

আর লেগেছিল ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর। বরিশাইল্যর কাঠ বাঙাল তিনি তখন ডাফ হোস্টেলে থাকেন। এই পাড়াটাতে আমি বড় হয়েছি, কাজেই বুঝতে পারি এখানেও কি ঘটেছিল। 

আজ এই ক্রান্তিকালে আমার অশীতিপর মাস্টারমশাই, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মাস্টারমশাই, যাঁর সাথে পনের বছর আগেও বহু ঘনিষ্ঠ আড্ডার মাঝে কখনো ধর্মের কথা তুলতে দেখিনি, তিনি বলছেন তিনি সনাতনী এবং যারা সনাতনী নয় তারা সবাই আতঙ্কবাদী। শান্তির বার্তা শিরদাঁড়াহীনতার লক্ষণ, তাই এবার শত্রু নিধন শুরু করা উচিত। এটা আমার কাছে অতীব দুঃখের এবং কষ্টের বিষয়। কিন্তু আমার কাছে আতঙ্কের বিষয় হল এই কথাগুলোকে অশীতিপরের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। শত শত লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী ভারতীয় এবং বহু অনাবাসী ভারতীয় এই একই সুরে “জিহাদ”,( হ্যাঁ জিহাদ ছাড়া উপযুক্ত শব্দ  নেই আর ) ঘোষণা করেছে। ঘটনাচক্রে বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত। নতুন একটা অদ্ভুত বুলি শুনছি, শান্তির বাণী হল নাকি রাজনীতি করা। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক অশান্তি এবং পহেলগামের ঘটনা নাকি একই। দুটোর যোগসূত্র থাকলে যে গভীর রাজনীতি, যে গভীর চক্রান্ত থাকতে হবে তার কথা তারা বলছে না। পহলগামে কেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না সেটা প্রশ্ন করাটাও রাজনীতি এবং সেই প্রশ্ন করার জন্য দৈনিক জাগরণের এক সাংবাদিক আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। 

শান্তির প্রশ্ন তোলার জন্য অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিচ্ছেদ হয়েছে গত কদিনে। “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে” মনে পড়ছে বারবার। আগে শুধু এই ভয়টুকুই ছিল, দাঙ্গা বাধলে আমার পাড়ার স্বল্প পরিচিত অন্য ধর্মের লোকে আমায় আক্রমণ করতে পারে। এখন মনে হচ্ছে আমি সনাতনী হতে পারব না ঘোষণা করার পর আমি সনাতনীদেরও নিশানায়। সেই সনাতনীদের দলে অনেকে আছে যারা এক সময় আমার ঘনিষ্ঠ ছিল। সংস্কারী সনাতনীদের মহিলাদের ওপর অত্যাচার করাটা তো প্রশংসনীয় কীর্তি।

 

ডঃ সুস্মিতা ঘোষ বায়োটেক স্টার্টআপ ডায়াগনোরাইটের প্রতিষ্ঠাত্রী, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানেটিকাট থেকে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস এর ডক্টরেট। 


New
ভাষা ও জাতি
আপনি নিজে কজন মুসলমানকে চেনেন?
নিজবাসভূমে পরভাষী


Other Writings by -ডঃ সুস্মিতা ঘোষ
ভাষা ও জাতি
ভাষা ও জাতি

ভাষাবিতর্ক নিয়ে তামিলনাড়ু বাদে আর যে দুটো রাজ্য হেডলাইনে আছে, তারা হল মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু…

নিজবাসভূমে পরভাষী
নিজবাসভূমে পরভাষী

বেঙ্গালুরুর এক ভদ্রলোক জনপ্রিয় সমাজমাধ্যম X হ্যান্ডেলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে, যে আরবান কোম্পানি নামে…

মহাকুম্ভের অমৃতবারি ও অন্ধদের হস্তিদর্শন
মহাকুম্ভের অমৃতবারি ও অন্ধদের হস্তিদর্শন

প্রয়াগরাজের মেলা সংলগ্ন…

গীয়ান ব’রে সিনড্রোম (GB Syndrome) নিয়ে কিছু কথা
গীয়ান ব’রে সিনড্রোম (GB Syndrome) নিয়ে কিছু কথা

মহারাষ্ট্রের বাসিন্দারা চিন্তায় পড়ে…


4thPillar

Support 4thPillarWeThePeople

Admin Login Donate
আমাদের কথা

আমরা প্রশ্ন করি সকলকে। আমরা বহুত্ববাদী, স্বাধীন, যুক্তিবাদী। আমরা সংশয়বাদী; তর্কশীল; আবার সহিষ্ণুও বটে। আসুন কথা হোক; পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাস রেখে আলোচনা হোক। মননের ইতিহাসে শেষ কথা বলার স্পর্ধা কারও যেন না হয়; আবার কোনও স্বরই যেন অকিঞ্চিৎকর বলে উপেক্ষিতও না হয়। এই রকম ভাবনার একটা ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী কমিউনিটি গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।

© 2023 4thPillarWeThepeople. All rights reserved & Developed By - 4thPillar LeadsToCompany
// Event for pushed the video